এই ঘটনাটি ঘটেছিলো আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে। আমি এবং আমার স্বামী দেশের বাইরে থাকতাম। কিন্তু আমার গর্ভধারণকালে নিরাপত্তার জন্য আমার আম্মু আমাকে দেশে চলে আসতে বলে। আমি আমার স্বামী সহ বাংলাদেশে চলে আসি। এখানে এসে আমাদের উত্তরায় একটি ফ্লাট ভাড়া করে থাকতে বলা হয়। আম্মু আমাদের সাথেই থাকতেন।

যেইদিনের ঘটনা বলছি সেদিন ছিল মঙ্গলবার। আমরা, অর্থাৎ আমি এবং আমার স্বামী মাঝে মাঝে বিকেলে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বের হতাম। সেদিনও আমরা গাড়ি নিয়ে বিকেলের দিকে ঘুরতে বের হই। মার্কেট থেকে টুকিটাকি কেনাকাটা করে গাড়িতে চড়ে ফেরার পথে চলছি। সামনে সিগন্যালের লাল বাটি জ্বলছে। গাড়িটা থামানোর সাথে সাথে আমাদের গাড়ির পাশে এক বুড়ি মহিলা এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার স্বামী প্রথমে খেয়াল করে নি। তবে মহিলার দাঁড়িয়ে থাকাটা কেমন যেনও অস্বস্তিদায়ক ছিল। তাই আমি ওকে বলে ১০ টাকার একটা নোট নিয়ে সেই মহিলার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু সে টাকাটা নিলো না। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, সে আমার পেটের দিকে তাকিয়ে আছে। ভালো করে ওড়না দিয়ে শরীর ঢেকে বসলাম। গাড়ির কাছ নামিয়েছিলাম টাকা দেয়ার জন্য। সেটা আবার উঠিয়ে দিলাম। সাথে সাথে ঐ মহিলা আমার চোখের দিকে তাকাল। কেমন যেনও একটা শয়তানি ঝিলিক দিয়ে উঠলো তার চোখে মুখে। সমগ্র ব্যাপারটা ঘটলো ১-২ মিনিটের মধ্যে। সিগন্যাল ছেড়ে দেয়ার পর আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো।

রাস্তা দিয়ে প্রায় ২০ মিনিট চলার পর সামনে আবার একটি সিগন্যালে থামতে হল আমাদের। সেদিনের পরিবেশ এবং আবহাওয়া খুবই সুন্দর ছিল। তাই গত কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি আমার মনে রইলো না। আমি চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিলাম। যেইমাত্র গাড়ি থেমেছে সাথে সাথে আমার পাশের জানালার কাছে নক করার আওয়াজ হল। চোখ মেলেই চমকে উঠলাম। সেই মহিলাটি দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির গায়ে হাত দিয়ে। আলতো করে টোকা দিচ্ছে গাড়ির কাঁচে। হিম শীতল ভয়ের একটা ঢেউ বয়ে গেলো পুরো শরীর দিয়ে। আমার স্বামীর হাত খামছে ধরলাম। হাতের নক দিয়ে জোরে খামছে ধরায় ও একটু চমকে উঠলো। বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো “কি হয়েছে??” আমি কোনমতে বললাম সেই মহিলা, যে গত সিগন্যালে ছিল। আমার স্বামী আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিলো। বলল, “তুমি বেশি বেশি চিন্তা করছ। চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকো। এসময় এতো চিন্তা করা ঠিক না।
আমি তাকে কিছুতেই বুঝাতে পারলাম না। যাই হোক, সেদিন ঠিকঠাক মতই বাসায় চলে আসি আমরা।

তার দুদিন পরের ঘটনা।
বাংলাদেশে চলে আসলেও আমার স্বামী মাঝে মাঝে তাদের অফিসের গুলশান শাখায় যেত। সেই সময়টা আমি শুয়ে বসে কাটিয়ে দিতাম। বাড়ির কাজ বা রান্নাবান্না আম্মু করে দিতো। তাই আমার তেমন কাজ ছিল না। সেদিন কিছুক্ষণ টিভি দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মন বসলো না। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম চলে এলো।
ঘুম ছুটে যায় নাকে অদ্ভুত একটি গন্ধ আসতে। বামে কাত হয়ে শুয়ে ছিলাম। অদ্ভুত গন্ধটা নাক দিয়ে যেনও জোর করে ঢুঁকে পড়ছে। আশ্চর্য, রুমে এই মুহূর্তে কারো থাকার কথা না। আর যেই গন্ধটা আসছে তা যে খানিকটা আতরের মতো তা বুঝতে সমস্যা হল না। ডানে কাত হয়ে দেখার চেষ্টা করলাম।
ঠিক সাথে সাথে হৃৎপিণ্ডটা লাফ দিয়ে গলার কছে চলে এলো। সেই অদ্ভুত মহিলাটি। যাকে সেদিন গাড়ি থেকে দেখেছিলাম। কেমন মাছের মতো শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমার দিকে। আর বিড়বিড় করে আস্তে আস্তে বলছে, “আয়, আমার কছে আয়!”

আমার মনে হল আমি স্বপ্ন দেখছি। নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, এটা কোনো ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। কেটে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। “সোমা, Calm Down! এটা শুধুমাত্র একটা স্বপ্ন। সব ঠিক আছে!” এই বলে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যেইমাত্র মহিলাটি ঝুঁকে আমার দিকে এলো এবং আলতো ভাবে আমার পায়ে স্পর্শ করলো, তখন আর নিজের উপর নিয়ন্ত্রন রাখতে পারলাম না। চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। অনেক চেষ্টার পর, “ইয়া আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ Save Me!” শব্দগুলো বের হল মুখ দিয়ে।

সাথে সাথে সেই মহিলা অনেকটা বাতাসের আকার ধারন করলো এবং শাঁই করে খোলা জানালা দিয়ে বের হয়ে গেলো। জানালার কপাটে জোরে ধাক্কা লাগায় একটা কপাট খুলে পর গেলো। এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হতদন্ত হয়ে আমার আম্মু ঘরে ঢুকলেন।

নিজেকে স্বাভাবিক করতে সেদিন অনেক সময় লেগেছিল। খবর শুনে আমার স্বামী দ্রুত বাসায় চলে আসে। সব খুলে বলার পর আম্মু বলে গরীব কাউকে একবেলা খাইয়ে দেয়ার জন্য। তারপরের দিনই কয়েকজন গরীবকে ডেকে খাইয়ে দেয় আমার আম্মু এবং আমার জামাই।

আমার ভয় ছিল হয়তো এতে আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হবে। কিন্তু, আল্লাহর রহমতে সে সুস্থ হয়েই জন্মায়। এই ঘটনা আমার মনে একটা বড়সড় ধাক্কা দেয়।

জানি অনেকেই বলবেন, গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোন বেড়ে যায়। মানুষ অনেক উল্টা পাল্টা দেখে। আমিও তাই করেছি। কিন্তু, সেই ভাঙ্গা জানালার কোনো প্রশ্ন খুঁজে পাই নি

ঘটনাটি পাঠিয়েছেনঃ নাহিদা আক্তার সোমা।
-সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

Post a Comment

Previous Post Next Post